মুনিরুল তারেকঃ
নার্স শব্দ শুনতেই চোখে ভেসে ওঠে সাদা অ্যাপ্রোন পরিহিত নারীর প্রতিচ্ছবি। এই সেবামূলক পেশায় পুরুষ নিয়োজিত থাকলেও নারীই আনুমানিক ৯০ শতাংশ। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, শুধু সংখ্যার দিক থেকেই নারীর আধিক্য এখানে। ওই গুটি কয়েক পুরুষের মধ্য থেকেই বৃহৎ নার্সিং সেক্টরের নেতৃত্ব নিয়ন্ত্রিত হয়ে আসছে।
সংখ্যায় বেশি হওয়া সত্ত্বেও এই পেশার অধিকাংশ নারীরা এখনো ‘নারীত্ব’ থেকে বের হতে না পারার কারণে নিজেরাই সম্মুখিন হচ্ছেন বহুবিধ বিভ্রান্ত-বিড়ম্বনার। আর এই ‘নারীত্বের’ ফায়দা লুটছে হাতেগোনা কিছু দুর্নীতিবাজ পুরুষ নার্স।
নার্সদের নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি অধিদপ্তর দীর্ঘদিনের অঘোষিত দুর্নীতির আঁখড়া। সেখান থেকে প্রাপ্য যে কোনো সুবিধা পেতেই ঘুষ দিতে হয় নার্সদের।
বদলি ও পদায়ন বাণিজ্য, হজ্ব টিমে এবং ট্রেনিংয়ে নাম দিতে ঘুষ, তিন বছর অন্তর রেস্ট ও রিক্রেশন বিল তুলতে এবং জি.পি.এফ’র টাকা ছাড় করাতে ঘুষ- এই সব অনিয়মই যেন নিয়ম সেখানে। বহু বছর ধরে এমন প্রথা চালু এই অধিদপ্তরে। অনেক নার্সই বলে থাকেন, ‘আমরা নারী বলেই ভয়-ভীতি দেখিয়ে কিংবা ভুলভাল বুঝিয়ে যাচ্ছে আমাদের পুরুষ সহকর্মীরাই’।
তবে আনুমানিক বছর খানেক ধরে দুর্নীতিবাজ শক্তিশালী সিন্ডিকেটটি চুপসে গেছে। অনেকটা বাধ্য হয়েই তারা নীরব দর্শক হয়ে আছেন। এর কারণ একজন আবদুল হাই!
নার্সিং অধিদপ্তরের পরিচালক (শিক্ষা) হিসেবে আবদুল হাই পিএএ নামের বিসিএস কর্মকর্তার যোগদান যেন এই সেক্টরের জন্য বড় ধাক্কা। বহু বছর ধরে চলমান ঘুষ-দুর্নীতির সিন্ডিকেটের সদস্যরা হয়ে পড়ে কর্মহীন! তাদের পেশাগত দায়িত্ব ঠিক থাকলেও যে পন্থায় তারা অবৈধ অর্থের মালিক হয়ে আসছিলেন, সেই বাণিজ্যে ভাটা পড়েছে। অধিদপ্তরের পূর্বতন কর্মকর্তাদের অর্থ, ভয় কিংবা উপর মহলের মাধ্যমে ম্যানেজ করে কাজ হাসিল করতে পারলেও এবার আর পাত্তাই পাচ্ছেন না তারা। নিজেদের নীরবতার কারণেই ‘অবলা’ হয়ে থাকা নারী নার্সরা যেন খুঁজে পেয়েছেন শক্তির শেকড়।
বেশ কয়েকজন সিনিয়র নার্স নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, ওই সিন্ডিকেটে একজন উপসচিব, নার্স সংগঠনের ৩/৪ জন নেতা এমনকি সাংবাদিকও জড়িত। যাদের কাছে ধর্না না দিয়ে পাওয়া যেতো না নিজের প্রাপ্য সুবিধা।
কিন্তু, তাদের সেই দাপট ভেঙে চৌচির। আবদুল হাই ওই সিন্ডিকেটকে অনেকটা ‘নপংশুক’ বানিয়ে দিয়েছেন। অর্থাৎ তাদের সুপারিশে কোনো কাজই হচ্ছে না নার্সিং অধিদপ্তরে। সেটি তারাও বুঝতে পারছেন; তাই ভিড়ছেনও না অধিদপ্তরের ধারে-কাছে।
এ কারণে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন সাধারণ নার্সরা। আবদুল হাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ্যে জানতে চাইছেন নার্সদের সমস্যার কথা, সমাধানও করে দিচ্ছেন প্রকাশ্যেই। দীর্ঘ বছর ধরে ঝুলে থাকা নানা জটিলতা নিমিষেই কেটে যাচ্ছে এই কর্মকর্তার হস্তক্ষেপে।
তবে আপাতত স্বস্তিতে থাকলেও পাশাপাশি দুশ্চিন্তাও করছেন সুফলভোগী সাধারণ নার্সরা। তারা অপ্রত্যাশিত হলেও প্রহর গুণছেন, কখন যেন বিদায় ঘন্টা বেজে যায় তাদের সুহৃদ আবদুল হাইয়ের!
কারণ, একেবারে বসে নেই ওই দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেট। তারাও ফন্দি আঁটছেন ‘আবদুল হাই হটাও’ মিশন বাস্তবায়নে। ওই সিন্ডিকেট এতটাই শক্তিধর যে, ইতোপূর্বে তাদের অবাধ্য হওয়ার কারণে অধিদপ্তরের উর্ধতন কয়েকজন কর্মকর্তাকে সরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন ষড়যন্ত্রের জালে ফেলে।
সম্প্রতি একটি জাতীয় সংবাদ মাধ্যমে আবদুল হাইকে নিয়ে অগ্রহণযোগ্য অভিযোগ তুলে সংবাদ প্রকাশ হওয়ায় সেই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে ধারণা করছেন সাধারণ নার্সরা।
উল্লেখ্য, এর আগে এই অধিদপ্তরের একজন মহাপরিচালক সততার সঙ্গে নার্সদের জন্য কাজ করতে গিয়ে খুব অল্প দিন টিকতে পেরেছিলেন চেয়ারে। আবদুল হাইয়ের ক্ষেত্রেও তেমনটি ঘটার আশঙ্কা করছেন দীর্ঘ বছর ধরে কেউ কেউ।