মুনিরুল তারেকঃ
দুর্নীতির মহাউৎসব চলছে বাংলাদেশ নার্সিং ও মিডওয়াইফারি কাউন্সিলে। নার্সিং রেজিস্ট্রার, ডেপুটি রেজিস্ট্রার এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তার চলতি দায়িত্বে থাকা ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। এদের নিজেদের নিয়োগেও ভেজাল এবং চাকরিরত অবস্থায় কাউন্সিলের অন্যান্য পদে নিয়োগ বাণিজ্য, চাকরিতে যোগদানের পূর্বেকার নানা অপকর্ম-মামলার আসামি হওয়া, কর্মস্থলে ঘুষ বাণিজ্যসহ বহু অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। সিংহভাগ পদগুলোয় নারী কর্মকর্তা থাকায় প্রশাসনিক কর্মকর্তা থাকা পুরুষ নিজের কব্জায় নিয়ে পুরো প্রতিষ্ঠানটি নিয়ন্ত্রণ করছে এবং তার বিরুদ্ধে নারী কেলেংকারির সুনির্দিষ্ট অভিযোগও রয়েছে। এসব অভিযোগের বিষয়ে ইতোপূর্বে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত করেছে।
স্বায়ত্ত্বশাসিত এই প্রতিষ্ঠানটির সেবাপ্রত্যাশি বেশ কয়েকজন নার্সিং কর্মকর্তা এবং মিডওয়াইফারি এসব বিষয়ে কথা বলেছেন সাংবাদিকদের সঙ্গে। কাউন্সিলের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বললে তিনিও নাম প্রকাশ না করার শর্তে অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
সূত্রগুলো জানিয়েছে, ২০০৬ কিংবা ’০৭ সালে নার্সিং কাউন্সিলের ডেপুটি রেজিস্ট্রার পদে নিয়োগ পান সুরাইয়া বেগম। এরপর রেজিস্ট্রার পদ খালি হলে প্রথমে ভারপ্রাপ্ত এবং পরে পূর্ণ রেজিস্ট্রার হন তিনি। ২০১২ অথবা ‘১৩ সালে তিনি একটি সেমিনারে যোগ দিতে ফিলিপাইনে গিয়েছিলেন। সেখানে একটি শপিং মল থেকে পণ্য চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েন। দেশটির আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তাকে আটক করে। পরবর্তীতে বাংলাদেশ স্বাস্থ্য সেক্টর ও দূতাবাসের প্রচেষ্টায় মুক্তি পান। দেশে ফেরার পর বিষয়টির তদন্ত হয় এবং তিনি তিন মাস বরখাস্তও ছিলেন। কিন্তু একপর্যায়ে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, সুরাইয়া বেগম নির্দোষ। ফিলিপাইনের ঘটনার তদন্ত বাংলাদেশে কতটা সুষ্ঠুভাবে হয়েছে, তা নিয়ে জোর বিতর্ক ও প্রশ্ন রয়েছে।
এছাড়া প্রাইভেট নার্সিং কলেজ অনুমোদনের ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগও রয়েছে। কলেজের অনুমোদনের ক্ষেত্রে কোনো শর্ত না মেনেও প্রশাসনিক কর্মকর্তার মাধ্যমে রেজিস্ট্রারকে ম্যানেজ করে পাওয়া যায় অনুমোদন। নির্ধারিত সংখ্যক শিক্ষক নিয়ে কলেজ করার কথা থাকলেও একই শিক্ষক একাধিক কলেজে দেখিয়ে অনুমোদন নেয়ার নজির আছে অনেক। প্রতি ৫ বছর পর নার্সিং রেজিস্ট্রেশন নবায়নে অতিরিক্ত টাকা আদায়, কাউন্সিলে ট্রেনিংয়ের নামে অর্থ লোপাটের অভিযোগও রয়েছে।
তার বিরুদ্ধে বড় দুর্নীতির অভিযোগ হচ্ছে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে ডেপুটি রেজিস্ট্রার পদের নিয়োগ বাণিজ্য। সূত্র জানিয়েছে- ২০১৬ সালে নার্সিং কাউন্সিলের ডেপুটি রেজিস্ট্রার পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো নিয়োগ বিধিরই তোয়াক্কা করা হয়নি। এক্ষেত্রে একাধিক পত্রিকায় ও কাউন্সিলের ওয়েবসাইটে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে নিয়োগ কার্যক্রম শুরু করার কথা। কিন্তু প্রশাসনিক কর্মকর্তার চলতি দায়িত্বে থাকা মঞ্জুরুল করিম ও রেজিস্ট্রার সুরাইয়া বেগম যোগসাজশ করে যেদিন ওই পদে আগ্রহীদের আবেদনের শেষ তারিখ ছিলো, সে দিন সন্ধ্যার পরে শুধুমাত্র নার্সিং কাউন্সিলের ওয়েবসাইটে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। এতে করে নিয়োগের বিষয়ে কেউ জানতেও পারেনি, আবেদনও করতে পারেনি। বর্তমানে ডেপুটি রেজিস্ট্রারের দায়িত্বে থাকা রাশিদা আক্তারকে জালিয়াতির সেই বার নিয়োগ পাইয়ে দেন রেজিস্ট্রার ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা।
এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে কথা বলতে রেজিস্ট্রার সুরাইয়া বেগমকে একাধিকবার ফোন করলে তিনি রিসিভ করেননি। পরে হোয়াটস্অ্যাপে সংবাদের কিছু অংশ প্রেরণ করে বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি বার্তা দেখলেও কোনো রিপ্লাই দেননি। পরে মোবাইল নম্বরে ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও কোনো সাড়া মেলেনি।
এদিকে, ডেপুটি রেজিস্ট্রার রাশিদা আক্তারের বিরুদ্ধেও রয়েছে ভয়াবহ অভিযোগ। তিনি রাজধানীর মগবাজার এলাকার হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালে সিনিয়র স্টাফ নার্স ছিলেন। বিভিন্ন অভিযোগের প্রেক্ষিতে তাকে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিতে বদলি করা হয়। সেখানে কর্মরত অবস্থায় মাঠ পরিদর্শনে গিয়ে একজন চিকিৎসকের স্বাক্ষর জাল করে বিল তুলে আত্মসাতের অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় চাকরিচ্যুত হন। এছাড়া তার বোনের সন্তানকে অপহরণ করার অভিযোগও রয়েছে রাশিদা আক্তারের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় তার দুলাভাইর দায়ের করা নারী ও শিশু নির্যাতন এবং অপহরণের পৃথক ৪টি মামলায় ঢাকা ও যশোরে কারাগারেও ছিলেন তিনি।

চাকরিবিধি অনুযায়ী ফৌজদারি মামলার আসামি থাকাবস্থায় কেউ সরকারি বা স্বায়ত্ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিতে পারবে না। তাই সংশ্লিষ্ট অনেকেই বলে থাকেন, অপহরণের মত ভয়াবহ অভিযোগ নিয়েও রাশিদা আক্তার ডেপুটি রেজিস্ট্রার পদে চাকরি পেয়েছেন ১৪ লাখ টাকা ঘুষের বিনিময়ে। এসব অসমর্থিত সূত্রের দাবি, ডেপুটি রেজিস্ট্রার পদে নিয়োগের ক্ষমতা রেজিস্ট্রার সুরাইয়া বেগমের না থাকলেও তিনি, প্রশাসনিক কর্মকর্তা মঞ্জুরুল করিম এবং তৎকালীন স্বাস্থ্য শিক্ষা সচিবের যৌথ কারসাজিতে অবৈধ পন্থায় নিয়োগ পান রাশিদা আক্তার।
হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট নার্সিং ইনস্টিটিউটের একজন শিক্ষক রাশিদা আক্তারের বিরুদ্ধে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলেন। তৎকালীন মন্ত্রী এ বিষয়ে তদন্তের নির্দেশ দিলেও অজ্ঞাত কারণে তা থমকে যায়।
এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে ক্ষুদে বার্তায় মন্তব্য জানতে চাইলে ডেপুটি রেজিস্ট্রার রাশিদা আক্তার বমমলিখে পাঠান, এটা সম্পূর্ণ বানোয়াট এবং ভিত্তিহীন ও অসত্য।
প্রশাসনিক কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা মঞ্জুরুল করিমের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি গোটা নার্সিং কাউন্সিলকে নিজের কব্জায় নিয়ে ইচ্ছেমত পরিচালনা করতে চান এবং অনেকটা সফলও হয়েছেন। রেজিস্ট্রার সুরাইয়া বেগম প্রতিষ্ঠানটির প্রধান হলেও প্রশাসনিক কর্মকর্তার ইশারা ও সিদ্ধান্ত মতই চলে সবকিছু। ভুক্তভোগীরা বলেছেন, একক আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হয়েছেন মঞ্জুরুল করিম।
সিদ্দিকুর রহমান নামের ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকার একজন বাসিন্দা স্বাস্থ্য শিক্ষা সচিব বরাবরে লিখিত অভিযোগে বলেছেন, মঞ্জুরুল করিমের স্ত্রী মাহমুদা খানম নার্সিং কাউন্সিলেরই উচ্চমান সহকারী পদে কর্মরত। এর মধ্যেই তিনি মহাখালী ক্যান্সার হাসপাতালে কর্মরত একজন বিএসসি নার্সকে ফুঁসলিয়ে বিয়ে করেছেন প্রথম স্ত্রীর সম্মতি না নিয়ে। নার্সিং পেশায় নারীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় এই প্রতিষ্ঠানটিতে নারীদের পদচারনাও বেশি। কিন্তু মঞ্জুরুল করিমের কারণে কাউন্সিল নারীদের জন্য অনিরাপদ বলে দাবি করা হয়।
ওই লিখিত অভিযোগে আরো বলা হয়, মঞ্জুরুল করিম তার স্ত্রী ছাড়াও সম্পর্কে ভাগ্নি সুমা ও আব্দুর রহমানকে অফিস সহকারী পদে, ভাতিজা তোফাজ্জেল হোসেনকে এমএলএসএস পদে এবং স্ত্রী মাহমুদা খানমের আত্মীয় মুরাদ সিকদারকে সহকারী প্রোগ্রামার পদে সহ আরো কয়েকটি পদে তার স্বজনদের দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে চাকরি পাইয়ে দিয়েছেন। এদের অনেকের চাকরি নিয়মিতও হয়েছে। এর মধ্যে মুরাদ সিকদারের চাকরি হয়েছে ২০১৬ সালে ডেপুটি রেজিস্ট্রার রাশিদা আক্তারের ওই নিয়োগের সময়ে। অর্থাৎ রাশিদার মত মুরাদের নিয়োগটিও বৈধ উপায়ে হয়নি। আর এ সবই হয়েছে প্রশাসনিক মঞ্জুরুল করিমের কারসাজিতে। তিনি জামায়াত-শিবিরের রাজনীতিতে বিশ্বাসী এবং তার নিয়োগ দেওয়া লোকেরাও ওই মতাদর্শেরই বলে উল্লেখ করা হয় লিখিত অভিযোগে।

মঞ্জুরুল করিমের বিরুদ্ধে দুদকের কাছে অভিযোগ রয়েছে। দুদক’র নির্দেশে নার্সিং ও মিডওয়াফারি অধিদপ্তর গঠিত ৩ সদস্যের কমিটি তার বিরুদ্ধে করা অভিযোগ তদন্ত করেছে।
অভিযোগ রয়েছে, ১১ বছর ধরে মঞ্জুরুল করিম প্রশাসনিক কর্মকর্তার চলতি দায়িত্ব পালন করছেন। কাউন্সিলে বিভিন্ন পদে লোক নিয়োগ হলেও ওই পদে থাকতে নিজস্ব ক্ষমতায় প্রশাসনিক কর্মকর্তার পদে নতুন নিয়োগ আটকে রেখেছেন। মঞ্জুরুল করিমের বিরুদ্ধে কাউন্সিলে যাওয়া নারীদের সঙ্গে কুরুচিপূর্ণ আচরণ এবং স্বেচ্ছাচারিতা ও দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে।
এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে ক্ষুদে বার্তায় মন্তব্য জানতে চাইলে প্রশাসনিক কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা প্রধান সহকারী মঞ্জুরুল করিম লিখে পাঠান, উল্লেখিত বিষয়টিতে আমার নাম ব্যবহার করে যে তথ্যগুলো উপস্থাপন করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট। বাংলাদেশ নার্সিং ও মিডওয়াইফারি কাউন্সিল একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা বিধায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অনুমোদন নীতিমালা অনুসরণপূর্বক নির্ধারিত কমিটি এবং মন্ত্রণালয়য়ের প্রশাসনিক অনুমোদনের প্রেক্ষিতে নার্সিং কাউন্সিল অধিভুক্তি প্রদান করে বিধায় কোনো একক ব্যক্তির পক্ষে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অনুমোদন দেওয়া সম্ভব না। এছাড়া বাংলাদেশ নার্সিং ও মিডওয়াইফারি কাউন্সিলের নিজস্ব বিধি না থাকায় নিয়োগ ও অন্যান্য কার্যক্রম সরকাররের বিধি সমুহ অনুসরণ করা হয় । আমি নির্দ্বিধায় সততার সঙ্গে কাউন্সিলে চাকরি করে আসছি এবং চাকরিরত অবস্থায় কোন ইনস্টিটিউটের মালিক পক্ষ বা কোনো ব্যক্তির কাছ থেকে কোনো কাজের বিনিময়ে টাকা পয়সা তো দূরের কথা এক কাপ চা কখনই গ্রহণ করিনি। কাউন্সিলে আমার জ্যেষ্ঠ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা রয়েছেন বিধায় যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের মতামত গ্রহণ করা হয়, এছাড়া আমার পদে থাকাকালীন অবস্থায় আমার আয়ত্বের মধ্যে কর্মচারীদের অনিয়ম প্রতিহত করার প্রচেষ্টা করেছি। এজন্য নানাভাবে শত্রুতামূলক মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য দিয়ে কিছু ব্যক্তিবর্গ নিজেদের স্বার্থ হাসিল করার উদ্দেশ্যে আমার ও কাউন্সিলের সুনাম নষ্ট করছে।
সার্বিক বিষয়ে স্বাস্থ্য শিক্ষা সচিব মোঃ আলী নূরকে ফোন করলে তিনি ফোন কেটে দেয়ায় তার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। তবে কাউন্সিলে গিয়ে নানা হয়রানির শিকার নার্স ও মিডওয়াফারিরা প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম সঠিকভাবে সচল রাখতে সেখান থেকে সকল দুর্নীতিবাজ ও স্বেচ্ছাচারি মনোভাবের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সরিয়ে দেয়ার আহ্বান জানান। তারা অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িতদের বিষয়ে গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করতে দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রতি জোর অনুরোধ জানিয়েছেন।